শেষ
পর্যন্ত আত্মহননের পথই বেছে নিলেন বিচিন্তা সম্পাদক মিনার মাহমুদ। গত ২৯
মার্চ ঢাকা রিজেন্সি হোটেল থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের সঙ্গে
পাওয়া যায় পাঁচ পৃষ্ঠার একটি চিঠি। স্ত্রী লাজুককে তিনি এ চিঠিটি লিখেন।
চিঠিতে আছে মিনার মাহমুদের জীবন, প্রেম, বিদেশে চলে যাওয়া থেকে শুরু করে
অনেক কিছু। চিঠিটি হুবহু তুলে দেওয়া হলো।
লাজুক,
আমার এই ৫৩ বছর বয়সী জীবনে অনেক অনেক মেয়েকে দেখেছি। কিন্তু তোমার উদাহরণের বাস্তব ব্যক্তিকে দেখিনি। অবাক হই, সৃষ্টিকর্তা কেন তোমার মতো মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন।
সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমি জানতাম, কোথায় যাচ্ছি, কী করতে যাচ্ছি। বুক ভেঙে কান্না আসছিল। চেষ্টা করেও চেপে রাখতে পারলাম না। এত দিনের চেনাজানা এ বাড়িতে আর ফিরব না। আর দেখা হবে না তোমার সঙ্গে । চেপে রাখা মুখ ঠেলে কান্না এল। নিজেকে খুন করে ফেলার এ আয়োজনে সবচেয়ে প্রতিবন্ধকতা ছিলে তুমি।
আমার মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়ে তোমার কান্না—ভাবতেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি। আবার সিদ্ধান্ত নিই। সেই লাজুক তুমি এখন নিঃসঙ্গ, একাকী।
তোমার মনে প্রথম প্রশ্ন আসবে, আমি কেন আত্মহত্যা করলাম? গতকাল দৈনিক আজকের প্রত্যাশা থেকে রিজাইন করেছি বলে? মোটেও না। আসলে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। কারও প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ আছে, আমার বাংলাদেশের সার্বিক সমাজব্যবস্থায়।
সাংবাদিকতা আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করলেও মাস্টার্স শেষ করতে পারিনি সাংবাদিকতা সূত্রে মাস্তানদের হুমকির কারণে। ক্যাম্পাস ছিল আমার জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। সাপ্তাহিক বিচিত্রা দিয়ে শুরু করেছিলাম। পদত্যাগে বাধ্য করা হলো আমাকে দুর্নীতির অভিযোগে। লতা হোসেন আমার জীবনের সবচেয়ে আত্মার বন্ধু। তাঁর সহযোগিতায় বিচিন্তা বের করলাম। মোটামুটি সফল। নিষিদ্ধ হলো কিছুদিন পর। জেলজীবন। তিন বছর বেকার। এরপর এলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একমাত্র সোল এজেন্ট খালেদা জিয়া। বিচিন্তা সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা। তখন সাপ্তাহিক কার্যদিবসের প্রতিটি দিনই হাজির থাকতে হতো কোর্টপাড়ায়। বুঝতে পারছিলাম, স্থায়ীভাবে জেলজীবন দেখানোর পরিকল্পনা আছে গণতান্ত্রিক সরকারের। উপায়হীন আমি পালিয়ে গেলাম আমেরিকায়। বিচিন্তা-সংশ্লিষ্ট কর্মীরা যাতে বেকার না হন, বিচিন্তা হস্তান্তর করে গেলাম ইউএনবির এনায়েতুল্লাহ খানের কাছে।
১৮ বছর দাসত্বের জীবন কাটিয়েছি আমেরিকায়। ১৮ হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি, কত কোটি টাকায় বিক্রি করেছ বিচিন্তা? সবাই শুধু বিকৃত মানসিকতার একটি বিষয়ই বিবেচনা করেছে। কিন্তু দেশে ফিরে ২০১০ সালে যখন এনায়েতুল্লাহ খানের কাছ থেকে বিচিন্তা ফিরিয়ে নেই, একজনও প্রশ্ন করেনি, কত টাকায় ফেরত নিলাম।
লাজুক, সাংবাদিকতা পেশায় মেধাহীন আমি শ্রমই দিয়েছি। নিউজপ্রিন্টের ওপর বলপয়েন্ট দিয়ে ক্রমাগত লিখে যাওয়া—হাত ফুলে উঠত। লাইট বাল্বের উত্তাপ দিয়ে সেক দেওয়া। আবার লেখা। নিজের কাছে প্রশ্ন করি, সাংবাদিকতা পেশার নাম বিনিয়োগ করে কখনো আমি কি কোনো সুবিধা নিয়েছি? নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখন চার হাজার টাকা। কোনো বাড়ি অথবা দেশের কোথাও এক ইঞ্চি জমি নেই। আক্ষরিক অর্থে সর্বহারা। একটা সময়ে বাংলাদেশকে আমি দেখেছি, পর্বতের উচ্চতা থেকে। নিজের জন্য সম্পদ, মাথায় আসেনি।
যে কথাটা বলতে চাইনি, নিউইয়র্কে আমার জীবনযাপন ছিল আত্মকেন্দ্রিক। বিচ্ছিন্ন ছিলাম দেশ এবং বাংলা ভাষা থেকে। নেটলাইনে কৃষ্ণকলির গানগুলো শুনতাম, এমন স্থির, কনফিডেন্স। বাংলাদেশ আবার বিজয় হয়ে আসে জীবনে। আর ঠিক এই সময়ে তুমি অপরাজিতা। নেটলাইনে পরিচয়, শুনি তোমার অসাধারণ জীবন্ত গান। সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশে আমার মৃতদেহও যাবে না। তাই শরীরের সবকিছু অগ্রিম দান করে রেখেছিলাম হাসপাতালে। তুমি বদলে দিলে সবকিছু।
লাজুক, আমি সিদ্ধান্ত নিই, ফিরে যাব দেশে। প্রথম দেখা হয় তোমার সঙ্গে বিমানবন্দরে। দীর্ঘ দেহী, শ্যামলা। আশ্চর্য চোখ তোমার। কথা বলে চোখের ভাষায়। তোমার আমার প্রথম দেখা, বিয়েসহ সব সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে আমরা চূড়ান্ত করে ফেলেছি। তুমি দাঁড়িয়েছিলে চেনা অথবা অচেনা মানুষটার জন্য। আমি তোমাকে দেখি সবটুকু। চারদিকে কোনোকিছু কেয়ার না করে কাছে টেনে বুকে নেওয়ার ইচ্ছা হয় তোমাকে।
এখন শোনো লাজুক। আমি সর্বহারা। ‘কিছু নেই’ একজন মানুষ। বিচিন্তা আবার প্রকাশ করেছিলাম, পাঠকেরা নেয়নি। পরে একটি চাকরির জন্য কত চেনা অচেনা পত্রিকা, মিডিয়ায় চেষ্টা করেছি, কেউ নেয়নি। অবাক হয়েছেন নিয়মিত লেখা এক সাংবাদিক। হাজিরা দেব, নিয়মিত লিখব, মাস শেষে একটা বেতন কোথাও হয়নি। কাউকে অভিযোগ করিনি।
লাজুক, বেশ কয়েক দিন ধরে চিন্তা করেছি—মৃত্যু। তারপর কোথায়? এরপর কি জীবনের আর কোনোকিছু ফিরে পাওয়া? খুব অবাক হয়েছি, বাংলাদেশের কোনো দৈনিক পত্রিকায় আমার স্থান হলো না।
বিচিন্তা শুরু করেছিলাম একদল তরুণ নিয়ে। বিরাট এক ঝুঁকি। কোনো পত্রিকা নেয় না। আমি নিয়ে নিয়েছিলাম। কারণ নতুন সাংবাদিক আনতে। খুব, খুব কষ্ট পেয়েছি, অপমানিত হয়েছি। যুগকে জিজ্ঞাসা করো, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নতুন ধারা যারা তৈরি করেছে, তাদের একজন আমিও।
আমি মিনার, আমেরিকা থেকে যখন দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই, শুনে সবাই অবাক। প্রশ্ন করে, বাংলাদেশে কেন ফিরে যাচ্ছি। আমি অবাক হই, নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছি—এটা নিয়ে প্রশ্ন কেন? কোথায় যাব আমি তাহলে?
লাজুক আমি নিজকে খুন করে ফেললাম। কোনো বিকল্প না পেয়ে। কাগজপত্রে আমি একজন আমেরিকাবাসী এখন। তুমি যেতে চাও না। বিদায় তোমাকে। তুমি চাওনি বলে আমি আমেরিকা যাইনি। দয়া করে বেঁচে থেকো লাজুক। প্লিজ প্লিজ.......(১৯ বার)। আমি এখন ট্যাবলেট খাচ্ছি।
লাজুক,
আমার এই ৫৩ বছর বয়সী জীবনে অনেক অনেক মেয়েকে দেখেছি। কিন্তু তোমার উদাহরণের বাস্তব ব্যক্তিকে দেখিনি। অবাক হই, সৃষ্টিকর্তা কেন তোমার মতো মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন।
সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমি জানতাম, কোথায় যাচ্ছি, কী করতে যাচ্ছি। বুক ভেঙে কান্না আসছিল। চেষ্টা করেও চেপে রাখতে পারলাম না। এত দিনের চেনাজানা এ বাড়িতে আর ফিরব না। আর দেখা হবে না তোমার সঙ্গে । চেপে রাখা মুখ ঠেলে কান্না এল। নিজেকে খুন করে ফেলার এ আয়োজনে সবচেয়ে প্রতিবন্ধকতা ছিলে তুমি।
আমার মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়ে তোমার কান্না—ভাবতেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি। আবার সিদ্ধান্ত নিই। সেই লাজুক তুমি এখন নিঃসঙ্গ, একাকী।
তোমার মনে প্রথম প্রশ্ন আসবে, আমি কেন আত্মহত্যা করলাম? গতকাল দৈনিক আজকের প্রত্যাশা থেকে রিজাইন করেছি বলে? মোটেও না। আসলে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। কারও প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ আছে, আমার বাংলাদেশের সার্বিক সমাজব্যবস্থায়।
সাংবাদিকতা আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করলেও মাস্টার্স শেষ করতে পারিনি সাংবাদিকতা সূত্রে মাস্তানদের হুমকির কারণে। ক্যাম্পাস ছিল আমার জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। সাপ্তাহিক বিচিত্রা দিয়ে শুরু করেছিলাম। পদত্যাগে বাধ্য করা হলো আমাকে দুর্নীতির অভিযোগে। লতা হোসেন আমার জীবনের সবচেয়ে আত্মার বন্ধু। তাঁর সহযোগিতায় বিচিন্তা বের করলাম। মোটামুটি সফল। নিষিদ্ধ হলো কিছুদিন পর। জেলজীবন। তিন বছর বেকার। এরপর এলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একমাত্র সোল এজেন্ট খালেদা জিয়া। বিচিন্তা সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা। তখন সাপ্তাহিক কার্যদিবসের প্রতিটি দিনই হাজির থাকতে হতো কোর্টপাড়ায়। বুঝতে পারছিলাম, স্থায়ীভাবে জেলজীবন দেখানোর পরিকল্পনা আছে গণতান্ত্রিক সরকারের। উপায়হীন আমি পালিয়ে গেলাম আমেরিকায়। বিচিন্তা-সংশ্লিষ্ট কর্মীরা যাতে বেকার না হন, বিচিন্তা হস্তান্তর করে গেলাম ইউএনবির এনায়েতুল্লাহ খানের কাছে।
১৮ বছর দাসত্বের জীবন কাটিয়েছি আমেরিকায়। ১৮ হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি, কত কোটি টাকায় বিক্রি করেছ বিচিন্তা? সবাই শুধু বিকৃত মানসিকতার একটি বিষয়ই বিবেচনা করেছে। কিন্তু দেশে ফিরে ২০১০ সালে যখন এনায়েতুল্লাহ খানের কাছ থেকে বিচিন্তা ফিরিয়ে নেই, একজনও প্রশ্ন করেনি, কত টাকায় ফেরত নিলাম।
লাজুক, সাংবাদিকতা পেশায় মেধাহীন আমি শ্রমই দিয়েছি। নিউজপ্রিন্টের ওপর বলপয়েন্ট দিয়ে ক্রমাগত লিখে যাওয়া—হাত ফুলে উঠত। লাইট বাল্বের উত্তাপ দিয়ে সেক দেওয়া। আবার লেখা। নিজের কাছে প্রশ্ন করি, সাংবাদিকতা পেশার নাম বিনিয়োগ করে কখনো আমি কি কোনো সুবিধা নিয়েছি? নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখন চার হাজার টাকা। কোনো বাড়ি অথবা দেশের কোথাও এক ইঞ্চি জমি নেই। আক্ষরিক অর্থে সর্বহারা। একটা সময়ে বাংলাদেশকে আমি দেখেছি, পর্বতের উচ্চতা থেকে। নিজের জন্য সম্পদ, মাথায় আসেনি।
যে কথাটা বলতে চাইনি, নিউইয়র্কে আমার জীবনযাপন ছিল আত্মকেন্দ্রিক। বিচ্ছিন্ন ছিলাম দেশ এবং বাংলা ভাষা থেকে। নেটলাইনে কৃষ্ণকলির গানগুলো শুনতাম, এমন স্থির, কনফিডেন্স। বাংলাদেশ আবার বিজয় হয়ে আসে জীবনে। আর ঠিক এই সময়ে তুমি অপরাজিতা। নেটলাইনে পরিচয়, শুনি তোমার অসাধারণ জীবন্ত গান। সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশে আমার মৃতদেহও যাবে না। তাই শরীরের সবকিছু অগ্রিম দান করে রেখেছিলাম হাসপাতালে। তুমি বদলে দিলে সবকিছু।
লাজুক, আমি সিদ্ধান্ত নিই, ফিরে যাব দেশে। প্রথম দেখা হয় তোমার সঙ্গে বিমানবন্দরে। দীর্ঘ দেহী, শ্যামলা। আশ্চর্য চোখ তোমার। কথা বলে চোখের ভাষায়। তোমার আমার প্রথম দেখা, বিয়েসহ সব সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে আমরা চূড়ান্ত করে ফেলেছি। তুমি দাঁড়িয়েছিলে চেনা অথবা অচেনা মানুষটার জন্য। আমি তোমাকে দেখি সবটুকু। চারদিকে কোনোকিছু কেয়ার না করে কাছে টেনে বুকে নেওয়ার ইচ্ছা হয় তোমাকে।
এখন শোনো লাজুক। আমি সর্বহারা। ‘কিছু নেই’ একজন মানুষ। বিচিন্তা আবার প্রকাশ করেছিলাম, পাঠকেরা নেয়নি। পরে একটি চাকরির জন্য কত চেনা অচেনা পত্রিকা, মিডিয়ায় চেষ্টা করেছি, কেউ নেয়নি। অবাক হয়েছেন নিয়মিত লেখা এক সাংবাদিক। হাজিরা দেব, নিয়মিত লিখব, মাস শেষে একটা বেতন কোথাও হয়নি। কাউকে অভিযোগ করিনি।
লাজুক, বেশ কয়েক দিন ধরে চিন্তা করেছি—মৃত্যু। তারপর কোথায়? এরপর কি জীবনের আর কোনোকিছু ফিরে পাওয়া? খুব অবাক হয়েছি, বাংলাদেশের কোনো দৈনিক পত্রিকায় আমার স্থান হলো না।
বিচিন্তা শুরু করেছিলাম একদল তরুণ নিয়ে। বিরাট এক ঝুঁকি। কোনো পত্রিকা নেয় না। আমি নিয়ে নিয়েছিলাম। কারণ নতুন সাংবাদিক আনতে। খুব, খুব কষ্ট পেয়েছি, অপমানিত হয়েছি। যুগকে জিজ্ঞাসা করো, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নতুন ধারা যারা তৈরি করেছে, তাদের একজন আমিও।
আমি মিনার, আমেরিকা থেকে যখন দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই, শুনে সবাই অবাক। প্রশ্ন করে, বাংলাদেশে কেন ফিরে যাচ্ছি। আমি অবাক হই, নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছি—এটা নিয়ে প্রশ্ন কেন? কোথায় যাব আমি তাহলে?
লাজুক আমি নিজকে খুন করে ফেললাম। কোনো বিকল্প না পেয়ে। কাগজপত্রে আমি একজন আমেরিকাবাসী এখন। তুমি যেতে চাও না। বিদায় তোমাকে। তুমি চাওনি বলে আমি আমেরিকা যাইনি। দয়া করে বেঁচে থেকো লাজুক। প্লিজ প্লিজ.......(১৯ বার)। আমি এখন ট্যাবলেট খাচ্ছি।
No comments:
Post a Comment