অবসরটা
সবাই নিজের মতো কাটায়। কেউ গান শোনে, কেউ বাগান করে। সুবীর বিশ্বাস অবসর
কাটান শিশুদের পড়িয়ে। তা-ও বিনে পয়সায়। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ও গরিব ঘরের
শিশুরা তাঁর ছাত্র। মাথার ওপর ছাউনি নেই। নেই বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল। আছেন
শুধু সুবীর। তাঁর টানেই ছুটে আসে শিশুরা। বিদ্যালয়ে না গেলেও পাঠশালায় তারা
হাজির হয় ঠিকঠাক।
স্থানীয়দের কাছে এটি ‘গাছতলার পাঠশালা’ নামে পরিচিত। এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের সৃজনশীল কাজে অনুপ্রেরণা দেন সুবীর। জন্ম থেকেই তাঁর পা দুটি স্বাভাবিক নয়। হাত দুটি থেকেও না থাকার মতো। শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে নিজে পড়ছেন, শিক্ষার আলোয় আলোকিত করছেন অন্যদেরও। নয় বছর আগে এই পাঠশালার যাত্রা শুরু। ঝরে পড়া অনেক শিশু সুবীরের ছায়াতলে এসে এখন বিদ্যালয়মুখী।
পাঠশালায় ছাত্রছাত্রী ৪৫ জন। এরা সবাই আশপাশের সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিদ্যালয় ছুটির পর বিকেলে তারা পাঠশালায় আসে। শুক্রবার বাদে সপ্তাহের ছয় দিন বেলা তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত পড়ানো হয় এখানে। শিক্ষার্থীরা কেউ পাঠশালার পড়ায় ফাঁকি দেয় না। সুবীর আদর করে তাদের চকলেট খাওয়ান। অভিভাবকেরাও ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর নেন।
এই পাঠশালায় শিক্ষার্থীদের শরীরচর্চা, খেলাধুলা, বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ছবি আঁকা বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা দেন সুবীর। মাস শেষে নেন মূল্যায়ন পরীক্ষা।
সুবীরের বেড়ে ওঠা: বয়স তাঁর ২২। বাড়ি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার অবদা গ্রামে। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের সংসারে তিনি চতুর্থ। বাবা বারীন্দ্র বিশ্বাস খেটে খাওয়া মানুষ। শিশুকালে বন্ধুদের সঙ্গে বিদ্যালয়ে যাওয়ার বায়না ধরতেন সুবীর। কিন্তু ছেলে যে আর দশটা শিশুর মতো নয়! কী করে বিদ্যালয়ে যাবে সে? বাবা-মায়ের এই দুশ্চিন্তা হার মানে সুবীরের আগ্রহের কাছে। ছেলেকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন তাঁরা। ঘরে বসে লেখার চর্চা করে চলেন সুবীর। দুই হাতের মাঝে কলম চেপে লিখতে শেখেন।
অবদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করেন। বাবার অভাবের সংসার। সুবীর চলে আসেন কিশোরগঞ্জের নিকলীতে। উপজেলার গুরুই ইউনিয়নের শিবিরপাড়া গ্রামে মামা সাধন বিশ্বাসের বাড়িতে ঠাঁই হয় তাঁর। মামা সুবীরকে স্থানীয় হিলচিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। বাড়ি থেকে বিদ্যালয় এক কিলোমিটার দূরের পথ। এই পা নিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে-আসতে উরু ফুলে যেত সুবীরের। তবু লেখাপড়া থামাননি।
এদিকে মামাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ভাগনের পড়ার খরচ চালাতে মামারা হিমশিম খাচ্ছিলেন। সেটা ২০০৩ সালের কথা। সুবীর তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। গৃহশিক্ষকের কাজ শুরু করেন। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রদের পড়াতেন। গৃহশিক্ষকতার টাকায় নিজের পড়ার খরচ হয়ে যেত। কিন্তু ভেতরে অন্য তাগিদ অনুভব করতেন সুবীর। চোখের সামনে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া দেখে বড্ড মায়া হতো তাঁর। একদিন ওদের নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন। ২০০৩ সাল থেকে শুরু, আজও পথচলা থামেনি।
নিজের পড়া, পাঠশালায় পড়ানোর পর গৃহশিক্ষকতা আজও ধরে রেখেছেন সুবীর। সন্ধ্যার পর বাড়িতে ১০ জন ছাত্রছাত্রী পড়ান। গৃহশিক্ষকতার সেই টাকায় পাঠশালার টুকটাক খরচাপাতি চলে।
‘অবসরটা ওদের দিলাম’: নিকলী সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে শিবিরপাড়া গ্রাম। মামাবাড়ির উঠানে সুবীরের পাঠশালা। জায়গাটি ছায়াঘেরা। সম্প্রতি এক বিকেলে ওই পাঠশালায় গিয়ে দেখা গেল, জনা চল্লিশেক শিশু সিমেন্টের বস্তার ওপর বসে আছে। মাথা দুলিয়ে কেউ পড়ছে, কেউ লিখছে। মাঝ বরাবর ফাঁকা স্থানটিতে চশমাপরা সুবীর একবার এদিকে, একবার ওদিকে যাচ্ছেন। মাঝে থেমে থেমে কাউকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কারোর মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।
আগন্তুক দেখে এগিয়ে আসেন সুবীর। তিনি জানান তাঁর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং এই কাজে জড়িয়ে পড়ার গল্প। ‘নানা কারণে গ্রামের কিছু ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে চায় না। অনেকে পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ে। আবার আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানকে প্রাইভেট পড়াতে পারেন না। কিছু অভিভাবক নিজেরাও পড়ালেখা জানেন না। তাঁদের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখায় খারাপ করছে। এসব সমস্যা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি যতটুকু জানি, অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেব।’ বললেন সুবীর।
পড়ানোর বিনিময়ে টাকা নেন না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে সুবীর বলেন, ‘টাকা নেই না এই ভেবে, দুই ঘণ্টা আমি তাদের লেখাপাড়া করাই। এই দুই ঘণ্টা আমার কোনো কাজ থাকে না। তাই অবসর সময়টা না হয় ওদেরই দিলাম।’ ভবিষ্যতেও মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি।
ঝরে পড়াদের পড়াতে পড়াতে দুই-দুবার নিজেই ঝরতে বসেছিলেন, জানান সুবীর। ২০০৬ সালে মানবিক বিভাগে এসএসসি দিয়ে বি গ্রেডে পাস করেন। এসএসসি পরীক্ষার আগে ও পরে দুই বছর করে পড়াশোনায় বিরতি দেন। অভাবের জন্য চারটি বছর বিসর্জন দেওয়ায় আফসোসের অন্ত নেই তাঁর। ২০০৯ সালে বাজিতপুর ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে চলতি বছর ব্যবসায় শিক্ষা থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন।
সবার কাছে প্রিয়: পশ্চিম গুরুই বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী নাছিমা আক্তার। সে প্রথম শ্রেণী থেকে এই পাঠশালায় পড়ছে। এখানে পড়তে খুব ভালো লাগে তার। একই বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র পার্থ রায় বলল, ‘কুনু দিন স্কুলে না গেলেও সুবীর স্যারের পাঠশালায় আসা বন্ধ করি না।’ তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র আসলাম মিয়া বলল, ‘এখানে শুধু লেহাপড়া করি না। রাস্তায় ক্যামনে চলতে হয়, বড়দের কীভাবে সম্মান করতে হয়, তা-ও শিখি।’
এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হারুন মিয়া জানান, গত কয়েক বছরে তাঁদের বিদ্যালয় থেকে আনুমানিক ৩০ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। সুবীরের পাঠশালায় পড়ার পর তারা পুনরায় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তাদের কেউ এখন দ্বিতীয়, কেউবা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সুবীর ভাই-বোনের মমতা দিয়ে বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাচ্ছে। শিশুরা ওকে ছাড়া কিছু বোঝে না। অনেক ছাত্র স্কুলে না গেলেও তার পাঠশালায় ঠিকই যায়।’
গুরুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লতিফা আক্তার জানান, সুবীরের গাছতলায় যারা লেখাপড়া করে, তারা বিদ্যালয়েও ভালো ফল করে।
একটি ঘর হলে ভালো হতো: স্থানীয় অভিভাবক দেলোয়ারা বেগম জানান, তাঁর ছেলে তাসলিম প্রথম শ্রেণীতে পড়ার পর আর স্কুলে যেত না। এলাকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বিকেলে সুবীরের পাঠশালায় যাওয়া শুরু করে। এরপর পুনরায় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এখন সে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে।
গুরুই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ফজলুল হক বলেন, ‘সুবীরের ঋণ শোধ করার নয়। ৪০-৪৫টি শিশুকে পড়িয়ে কোনো টাকা-পয়সা নেয় না ছেলেটা। তাকে বারবার টাকা দিতে চেয়েও কোনো অভিভাবক টাকা দিতে পারেননি।’
নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পাঠশালাটি দেখতে গিয়ে শিক্ষা উপকরণ কেনার জন্য তাকে দুই হাজার টাকা দিয়েছি।’ সুবীরের পাঠশালার জন্য একটি ঘরের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি।
স্থানীয়দের কাছে এটি ‘গাছতলার পাঠশালা’ নামে পরিচিত। এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের সৃজনশীল কাজে অনুপ্রেরণা দেন সুবীর। জন্ম থেকেই তাঁর পা দুটি স্বাভাবিক নয়। হাত দুটি থেকেও না থাকার মতো। শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে নিজে পড়ছেন, শিক্ষার আলোয় আলোকিত করছেন অন্যদেরও। নয় বছর আগে এই পাঠশালার যাত্রা শুরু। ঝরে পড়া অনেক শিশু সুবীরের ছায়াতলে এসে এখন বিদ্যালয়মুখী।
পাঠশালায় ছাত্রছাত্রী ৪৫ জন। এরা সবাই আশপাশের সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিদ্যালয় ছুটির পর বিকেলে তারা পাঠশালায় আসে। শুক্রবার বাদে সপ্তাহের ছয় দিন বেলা তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত পড়ানো হয় এখানে। শিক্ষার্থীরা কেউ পাঠশালার পড়ায় ফাঁকি দেয় না। সুবীর আদর করে তাদের চকলেট খাওয়ান। অভিভাবকেরাও ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর নেন।
এই পাঠশালায় শিক্ষার্থীদের শরীরচর্চা, খেলাধুলা, বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ছবি আঁকা বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা দেন সুবীর। মাস শেষে নেন মূল্যায়ন পরীক্ষা।
সুবীরের বেড়ে ওঠা: বয়স তাঁর ২২। বাড়ি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার অবদা গ্রামে। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের সংসারে তিনি চতুর্থ। বাবা বারীন্দ্র বিশ্বাস খেটে খাওয়া মানুষ। শিশুকালে বন্ধুদের সঙ্গে বিদ্যালয়ে যাওয়ার বায়না ধরতেন সুবীর। কিন্তু ছেলে যে আর দশটা শিশুর মতো নয়! কী করে বিদ্যালয়ে যাবে সে? বাবা-মায়ের এই দুশ্চিন্তা হার মানে সুবীরের আগ্রহের কাছে। ছেলেকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন তাঁরা। ঘরে বসে লেখার চর্চা করে চলেন সুবীর। দুই হাতের মাঝে কলম চেপে লিখতে শেখেন।
অবদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করেন। বাবার অভাবের সংসার। সুবীর চলে আসেন কিশোরগঞ্জের নিকলীতে। উপজেলার গুরুই ইউনিয়নের শিবিরপাড়া গ্রামে মামা সাধন বিশ্বাসের বাড়িতে ঠাঁই হয় তাঁর। মামা সুবীরকে স্থানীয় হিলচিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। বাড়ি থেকে বিদ্যালয় এক কিলোমিটার দূরের পথ। এই পা নিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে-আসতে উরু ফুলে যেত সুবীরের। তবু লেখাপড়া থামাননি।
এদিকে মামাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ভাগনের পড়ার খরচ চালাতে মামারা হিমশিম খাচ্ছিলেন। সেটা ২০০৩ সালের কথা। সুবীর তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। গৃহশিক্ষকের কাজ শুরু করেন। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রদের পড়াতেন। গৃহশিক্ষকতার টাকায় নিজের পড়ার খরচ হয়ে যেত। কিন্তু ভেতরে অন্য তাগিদ অনুভব করতেন সুবীর। চোখের সামনে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া দেখে বড্ড মায়া হতো তাঁর। একদিন ওদের নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন। ২০০৩ সাল থেকে শুরু, আজও পথচলা থামেনি।
নিজের পড়া, পাঠশালায় পড়ানোর পর গৃহশিক্ষকতা আজও ধরে রেখেছেন সুবীর। সন্ধ্যার পর বাড়িতে ১০ জন ছাত্রছাত্রী পড়ান। গৃহশিক্ষকতার সেই টাকায় পাঠশালার টুকটাক খরচাপাতি চলে।
‘অবসরটা ওদের দিলাম’: নিকলী সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে শিবিরপাড়া গ্রাম। মামাবাড়ির উঠানে সুবীরের পাঠশালা। জায়গাটি ছায়াঘেরা। সম্প্রতি এক বিকেলে ওই পাঠশালায় গিয়ে দেখা গেল, জনা চল্লিশেক শিশু সিমেন্টের বস্তার ওপর বসে আছে। মাথা দুলিয়ে কেউ পড়ছে, কেউ লিখছে। মাঝ বরাবর ফাঁকা স্থানটিতে চশমাপরা সুবীর একবার এদিকে, একবার ওদিকে যাচ্ছেন। মাঝে থেমে থেমে কাউকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কারোর মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।
আগন্তুক দেখে এগিয়ে আসেন সুবীর। তিনি জানান তাঁর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং এই কাজে জড়িয়ে পড়ার গল্প। ‘নানা কারণে গ্রামের কিছু ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে চায় না। অনেকে পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ে। আবার আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানকে প্রাইভেট পড়াতে পারেন না। কিছু অভিভাবক নিজেরাও পড়ালেখা জানেন না। তাঁদের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখায় খারাপ করছে। এসব সমস্যা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি যতটুকু জানি, অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেব।’ বললেন সুবীর।
পড়ানোর বিনিময়ে টাকা নেন না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে সুবীর বলেন, ‘টাকা নেই না এই ভেবে, দুই ঘণ্টা আমি তাদের লেখাপাড়া করাই। এই দুই ঘণ্টা আমার কোনো কাজ থাকে না। তাই অবসর সময়টা না হয় ওদেরই দিলাম।’ ভবিষ্যতেও মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি।
ঝরে পড়াদের পড়াতে পড়াতে দুই-দুবার নিজেই ঝরতে বসেছিলেন, জানান সুবীর। ২০০৬ সালে মানবিক বিভাগে এসএসসি দিয়ে বি গ্রেডে পাস করেন। এসএসসি পরীক্ষার আগে ও পরে দুই বছর করে পড়াশোনায় বিরতি দেন। অভাবের জন্য চারটি বছর বিসর্জন দেওয়ায় আফসোসের অন্ত নেই তাঁর। ২০০৯ সালে বাজিতপুর ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে চলতি বছর ব্যবসায় শিক্ষা থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন।
সবার কাছে প্রিয়: পশ্চিম গুরুই বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী নাছিমা আক্তার। সে প্রথম শ্রেণী থেকে এই পাঠশালায় পড়ছে। এখানে পড়তে খুব ভালো লাগে তার। একই বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র পার্থ রায় বলল, ‘কুনু দিন স্কুলে না গেলেও সুবীর স্যারের পাঠশালায় আসা বন্ধ করি না।’ তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র আসলাম মিয়া বলল, ‘এখানে শুধু লেহাপড়া করি না। রাস্তায় ক্যামনে চলতে হয়, বড়দের কীভাবে সম্মান করতে হয়, তা-ও শিখি।’
এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হারুন মিয়া জানান, গত কয়েক বছরে তাঁদের বিদ্যালয় থেকে আনুমানিক ৩০ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। সুবীরের পাঠশালায় পড়ার পর তারা পুনরায় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তাদের কেউ এখন দ্বিতীয়, কেউবা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সুবীর ভাই-বোনের মমতা দিয়ে বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাচ্ছে। শিশুরা ওকে ছাড়া কিছু বোঝে না। অনেক ছাত্র স্কুলে না গেলেও তার পাঠশালায় ঠিকই যায়।’
গুরুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লতিফা আক্তার জানান, সুবীরের গাছতলায় যারা লেখাপড়া করে, তারা বিদ্যালয়েও ভালো ফল করে।
একটি ঘর হলে ভালো হতো: স্থানীয় অভিভাবক দেলোয়ারা বেগম জানান, তাঁর ছেলে তাসলিম প্রথম শ্রেণীতে পড়ার পর আর স্কুলে যেত না। এলাকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বিকেলে সুবীরের পাঠশালায় যাওয়া শুরু করে। এরপর পুনরায় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এখন সে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে।
গুরুই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ফজলুল হক বলেন, ‘সুবীরের ঋণ শোধ করার নয়। ৪০-৪৫টি শিশুকে পড়িয়ে কোনো টাকা-পয়সা নেয় না ছেলেটা। তাকে বারবার টাকা দিতে চেয়েও কোনো অভিভাবক টাকা দিতে পারেননি।’
নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পাঠশালাটি দেখতে গিয়ে শিক্ষা উপকরণ কেনার জন্য তাকে দুই হাজার টাকা দিয়েছি।’ সুবীরের পাঠশালার জন্য একটি ঘরের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি।
No comments:
Post a Comment